গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকাঃ গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসে সাধারণত বাড়তি খাবারের প্রয়োজন হয় না। তবে এর পরের মাসগুলোতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কিছুটা বেশি খাবার খেতে হবে। এক্ষেত্রে একটি সুষম খাবার তালিকা মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
মা হতে চলেছেন, এজন্য আপনাকে অভিনন্দন! অনাগত সন্তান নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে মনে অনেক প্রশ্নও আসছে। তার মধ্যে একটি বিষয় সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তা হলো: আমার কী খাওয়া উচিত?
জীবনের সব পর্যায়েই স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গর্ভাবস্থায় এটা বিশেষভাবে জরুরি। সুষম খাবার আপনার সন্তানের বেড়ে ওঠা, তার বিকশিত হওয়া এবং সঠিক ওজন বজায় রাখতে সহায়তা করবে।
পরিবারের নতুন সদস্যের কল্যাণের জন্য কীভাবে আপনার খাবার তালিকায় পরিবর্তন আনবেন, তা জানতে আমাদের টিপসগুলো দেখুন।
গর্ভধারণকালে সুষম খাবারের তালিকা কীভাবে অনুসরণ করব?
একটি পুষ্টিকর খাবার তালিকা তখনই নিশ্চিত হয় যখন মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সবগুলো খাদ্য উপাদানযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার প্রতিদিনের খাবার তালিকায় থাকে।
গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবার খাওয়া মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই একান্ত প্রয়োজনীয়। খাবারে যাতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। ফলে যে কোনও দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য রোজকার খাদ্যতালিকায় থাকতেই হবে।
গর্ভবতী মহিলাদের রোজের খাবার তালিকায় ডাল, সোয়াবিন, বাদাম জাতীয় খাদ্যদ্রব্যও থাকা প্রয়োজন। এই জাতীয় খাদ্যদ্রব্যে ফাইবার, প্রোটিন, আয়রন, ফোলেট ও ক্যালসিয়াম থাকে। এই সমস্ত কিছুই শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয়।
মিষ্টি আলু বা রাঙা আলু শুধু খেতেই যে সুস্বাদু তা নয়, এতে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন থাকে। এটি উদ্ভিদে পাওয়া এক ধরণের যৌগ যা মানব শরীরে ভিটামিন এ-তে পরিণত হয়। রাঙা আলুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবারও পাওয়া যায়।
স্যামন মাছও হবু মায়েদের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব উপকারী। এই মাছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে যা বাচ্চার মস্তিষ্ক ও চোখের পুষ্টি জোগায়।
খাদ্যতালিকায় ডিম থাকা মাস্ট। ডিমে প্রায় প্রয়োজনীয় সব রকমেরই পুষ্টি মজুত থাকে। একটা বড় ডিমে ৮০ ক্যালরি, প্রচুর প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ থাকে।
সবুজ শাকসব্জি তো অবশ্যই যে কোনও পুষ্টিকর খাদ্যতালিকার অন্যতম প্রধান উপাদান। এতে ফাইবার, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম থাকে।
চর্বিহীন মাংস শরীরে উচ্চমানের প্রোটিন জোগায়। নানা ধরনের রেড মিটে আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকে যা রক্ত গাঢ় করতে সাহায্য করে।
চর্বিহীন মাংস শরীরে উচ্চমানের প্রোটিন জোগায়। নানা ধরনের রেড মিটে আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকে যা রক্ত গাঢ় করতে সাহায্য করে।
গোটা শস্য অবশ্যই পুষ্টিকর খাদ্য তালিকায় থাকা উচিত। এর থেকে ফাইবার, ভিটামিন মেলে। কিছু গোটা দানা শস্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিনও থাকে।
অ্যাভোকাডোয় মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। এর ফলে এই ফলে স্বাদ খানিকটা মাখনের মতো হয় এবং কোনও রান্নায় দিলে তার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। এতেও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি, ভিটামিন কে, ভিটামিন ই, ভিটামিন সি, ফাইবার, পটাশিয়াম, তামা থাকে।
শুকিয়ে নেওয়া ফলে সাধারণত প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরি, ফাইবার, বিভিন্ন রকমের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ থাকে। এক টুকরো ড্রাই ফ্রুটে একটা তাজা ফলের সমান পুষ্টি থাকে। ফলটা শুধু জল ছা়ড়া হয়।
মাছের যকৃৎ থেকে প্রাপ্ত তেলও শরীরের পক্ষে খুব ভাল। এতে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড EPA ও DHA থাকে। এগুলিও মস্তিষ্ক ও চোখের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয়।
সর্বোপরি যা প্রয়োজন তা হল বিপুল পরিমাণে জল খাওয়া। শরীরকে যথাসম্ভব হাইড্রেটেড রাখা একান্ত প্রয়োজনীয়। গর্ভাবস্থায় রক্তের পরিমাণ ৪৫ শতাংশ বেড়ে যায়। তাই শরীরে পর্যাপ্ত জল থাকা খুব দরকার।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
যথেষ্ট পরিমাণে ফলিক এসিড প্রাপ্তি কীভাবে নিশ্চিত করা যায়?
শুধু খাবার থেকে দৈনিক ৬০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড পাওয়াটা কঠিন হওয়ায় আপনি প্রতিদিন সম্পূরক হিসেবে অন্তত ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড সেবন করতে পারেন। তাতে আপনার প্রয়োজনটা পূরণ হবে। আপনি সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করার সময় থেকেই বা গর্ভধারণ নিশ্চিত হলেই এটা নেওয়া শুরু করতে পারেন। আপনার জন্য কোন সম্পূরকটি উপযুক্ত, সেটা বোঝার জন্য আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।
গর্ভাবস্থায় কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত?
গর্ভবতী মায়েদের নির্দিষ্ট কিছু খাবার থেকে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আর তা গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি করতে পারে। গর্ভধারণকালে আপনাকে যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে:
- কাঁচা, পাস্তুরায়ন ছাড়া দুধ এবং ওই ধরনের দুধ থেকে তৈরি কোমল পনির। এগুলোতে লিসটেরিয়া নামের এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা লিসটেরিওসিস নামের এক ধরনের রোগ তৈরি করতে পারে।
- মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার। কারণ সেগুলোতে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
- কাঁচা ও পুরোপুরি রান্না না হওয়া মাংসজাত পণ্য যেমন সসেজ ও কোল্ড কাট। এগুলোতে টোকসোপ্ল্যাজমা গনডির মতো পরজীবী এবং সালমোনিলা ও লিসটেরিয়ার মতো ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
- কাঁচা মাছ ও সিফুড। কারণ এগুলোতে উচ্চমাত্রায় ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী থাকতে পারে।
- কিছু মাছে উচ্চ মাত্রায় পারদ (মার্কারি) থাকে এবং এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। বেশির ভাগ শিকারি মাছ যেমন হাঙ্গর, সোর্ড ফিশ, মার্লিন ও কিং ম্যাককেরেলে মার্কারি বেশি থাকে।
- স্মোকড কিন্তু রান্না না করা মাছ যেমন, স্মোকড স্যালমন।
- রান্না না করা অঙ্কুরিত বীজ, খাদ্যশস্য ও শিম। কাঁচা মূলা, শিম ও আলফালফার বীজ এবং রেডি-টু-ইট সালাদ এসব খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এগুলোতে লিসটেরিয়া, সালমোনিলা ও ই. কোলির মতো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
- কাঁচা বা কম সিদ্ধ ডিম। এতে সালমোনিলা ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
- যকৃত (লিভার) ও অন্যান্য অঙ্গের মাংস। যকৃতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকলেও এটা গর্ভধারিণী নারীদের খেতে বলা হয় না। কারণ এতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ থাকে এবং এই মাংসে বিষক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে।
গর্ভবতী মার জন্য কীভাবে নিরাপদে খাবার প্রস্তুত করা যায়?
- খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
- ব্যবহারের পর সব পাত্র ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
- মাংস পুরোপুরি রান্না করতে হবে।
- রান্না না করা শাকসবজি, সালাদের সবজি ও ফলমূল খুব সতর্কতার সঙ্গে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
- যথাযথ তাপমাত্রায় খাবার সংরক্ষণ করতে হবে।
- রান্নার পরপরই খাবার খেয়ে নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় কতটা বেশি খাওয়া দরকার?
প্রথম তিন মাসে আপনার কোনো বাড়তি খাবারের দরকার নেই। দ্বিতীয় তিন মাসে প্রতিদিন আপনার ৩৪০ ক্যালোরি বাড়তি দরকার হবে। আর শেষ তিন মাসে আপনার প্রতিদিন অতিরিক্ত ৪৫০ ক্যালোরি দরকার হবে। এই বাড়তি শক্তির জন্য হাতের কাছে স্বাস্থ্যকর হালকা খাবার যেমন বাদাম, দই ও তরতাজা ফলমূল রাখবেন। এ বিষয়ে উপযুক্ত পরিকল্পনা পেতে আপনার স্বাস্থ্য সেবাদাতার সঙ্গে কথা বলুন।
গর্ভধারণকালে কি ভেজিটেরিয়ান বা ভিগান ডায়েট মেনে চলা উচিত?
আপনি যদি ভেজিটেরিয়ান বা ভিগান ডায়েট অনুসরণ করেন তাহলে আপনাকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, আপনি যথেষ্ট পরিমাণে আয়রন, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘বি১২’ ও ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করছেন। এ বিষয়ে সমাধান পেতে আপনার চিকিৎসক বা রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে কথা বলুন।
রিভিউ দিন