স্মার্টফোন আসক্তি – ফ্লিপ ফোন কি আপনার জন্য ভাল হবে?

স্মার্টফোন আসক্তি – বর্তমান সময়ে স্মার্টফোনের চাহীদা ব্যপক এবং সেই সাথে প্রতিযোগিতাও বেশী। সময়ের সাথে সাথে স্মার্টফোনের কনফিগারেশন অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ডিজাইন এবং যুক্ত হচ্ছে আরো উন্নত টেকনোলোজি। আর তার জন্যই স্মার্টফোন হয়ে উঠেছে প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের একটি বড় অংশ। তবে স্মার্টফোনে যুক্ত হওয়া নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার জ্ঞান কি সবার আছে? বিশেষ করে যারা বয়ষ্ক রয়েছেন তারা কিন্তু খুব বেশী একটা বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে সম্পৃক্ত না। তারা চাইলেই কিন্তু সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদেরকে স্মার্টফোনের সাথে কানেক্টেড করতে পারেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার এর ২০২১ এর তথ্যমতে, ৬৫ বছরের বেশী বয়সী ব্যক্তি, নিম্ন আয়ের মানুষেরা এবং স্কুল শিক্ষকেরা মূলত স্মার্টফোনের সাথে অতটা কানেক্টেট না। তারা বেশীরভাগই নরমাল ফিচার ফোন ব্যবহার করে থাকেন। এক্ষেত্রে ফ্লিপ / ফিচার ফোন কি আপনার জন্য ভাল হবে? চলুন এই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করা যাক –

রাইয়ান আদ্রিক (৪৪) একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, যিনি ওপেন সোর্স স্মার্টফোন সফটওয়্যার মডিফাই এবং রিপেয়ার করে থাকেন। প্রযুক্তি জ্ঞান এবং স্মার্টফোন ব্যবহার এর পারদর্শিতা নিয়ে তার উপর কোন প্রশ্ন নেই। তবুও তিনি তার আইফোন ব্যবহার করা বর্জন করেছেন। তিনি বলেন, আইফোন ব্যবহার না করার ফলে আমাকে বাড়তি প্রযুক্তি বা অ্যাপ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। আমি আমার দৈনন্দিনের প্রয়োজনীয় কাজগুলো নরমাল ফ্লিপ ফোনের মাধ্যমেই করতে পারি। এতে করে আমার বাড়তি সময় অপচয় হয়না। আমি আমার ডেভেলপমেন্ট এর কাজে পূর্ণ সময় পাই।

স্মার্টফোন আসক্তি – কোকেনের সমতুল্যঃ

গবেষকরা বলেন যে, স্মার্টফোন নির্ভরতা তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ এবং হতাশার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে, ঘুমের ধারাবিহকতা ব্যাহত করতে পারে, এমনকি ব্রেইনের ক্ষমতাও হ্রাস করতে পারে।

এটি ব্যবহারের ফলে আমাদের ক্ষতি হওয়া সত্বেও, প্রচুর স্মার্টফোন ব্যবহারকারী রয়েছে, বিশেষ করে তরুণ’রা যারা সারাদিন স্মার্টফোন ব্যবহার করে থাকেন। কোম্পানিগুলো মূলত স্মার্টফোন ডিজাইন করে থাকেন ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য। তাই আকর্ষণীয় ডিজাইন প্রত্যেক ব্যবহারকারীদের মধ্যে মস্তিষ্কে ডোপামাইন বৃদ্ধি করে দেয় স্মার্টফোনটির দিকে আকর্ষিত করার জন্য। স্মার্টফোনে আসক্তি কে গবেষকগণ কোকেনের সাথে তুলনা করেছেন। এবং অবশ্যই, স্মার্টফোনগুলি বাস্তব জীবনের সামাজিক চলাফেরায় গণ্ডগোল সৃষ্টি করে। বেশীরভাগ স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া, গেইম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন এবং অপরিচিত মানুষদের সাথে সময় কাটান, তাদের সাথেই পরিচিত হন। এর ফলে বাবা-মা, পরিবার, বন্ধুবান্ধবের সাথে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

পিউ এর গবেষণা মতে – 2015 সালে, প্রায় 90 শতাংশ লোক তাদের সামাজিক কার্যকলাপের সময় তাদের ফোন ব্যবহারের কথা জানিয়েছেন। যার জন্য বাস্তব জীবনের সামাজিক কাজে তাদের খুব একটা অবদান দেখা যায়না। তরুণ’রা যেখানে তাদের বিভিন্ন সোশ্যাল ওয়ার্ক করার কথা, সেই সময়টাতে তারা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়/ গেইমে আসক্ত হয়ে পরেছেন। যা ইয়ং জেনারেশন এর তরুণ’রা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।

স্মার্টফোনের আসক্তির মাধ্যমে তরুণ’রা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভয়ংকর আচরণ শুরু করেন এবং তাদের মানসিক বিপর্যয়ের মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যাওয়ার জন্য নানান রকম অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পরেন, যৌন হয়রানি, হ্যারেজমেন্ট, পর্ণগ্রাফি, ধর্ষণ ইত্যাদি সব খারাপ কাজে আসক্ত হয়ে পড়েন।

ফ্লিপ বা নরমাল ফিচার ফোন কি – দামে কম মানে ভাল?

ফ্লিপ বা ফিচার ফোন গুলো অবশ্যই সব দিক থেকে বেটার পারফর্মেন্স দিতে পারে না এটা নিশ্চিত। স্মার্টফোনের তুলনায় এগুলোর ক্যামেরা অতটা ইউজফুল এবং আকর্ষণীয় হয় না। তাছাড়া স্মার্টফোনের কিবোর্ড সিস্টেম ভাল থাকায় টাইপিং/টেক্সটিং করে ভাল পারফর্মেন্স নিশ্চিত করা যায়। যা ফ্লিপ ফোনের T9 কিবোর্ডটি টাইপিং -এ যথেষ্ট পেইনফুল।

ট্রাভেল বা ভ্রমণের জন্য ফ্লিপ ফোনগুলো যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়, বর্তমানে প্রায় সবাই গুগোল ম্যাপ এর মত ন্যাভিগেশন অ্যাপ গুলো ব্যবহার করে থাকেন ভ্রমণযাত্রা নিরাপদ করার জন্য। যা নরমাল ফিচার ফোনে সম্ভব হয়না।

এছাড়াও যারা আউটসোর্সিং করেন তাদের জন্য স্মার্টফোন খুব প্রয়োজনীয় একটি ডিভাইস। ফ্রিল্যান্সার’রা যখন বাইরে থাকেন বা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন তখন স্মার্টফোনের মাধ্যমে তাদের ফ্রিল্যান্সিং প্রোফাইল হ্যান্ডেল করে থাকেন। ফিচার ফোনে তা সম্ভব না।

বর্তমান প্রযুক্তি বিশ্বে বিভিন্ন ডিজিটাল সেবা স্মার্টফোন নির্ভর হয়ে গিয়েছে যার জন্য বাধ্যতামূলক অনেক ব্যবহারকারীকে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে হয়।

আপনার জন্য কোনটা ব্যবহারযোগ্য? স্মার্টফোন নাকি ফিচার ফোন?

যদিও স্মার্টফোন আসক্তি স্পষ্টভাবে স্বাস্থ্যের জন্য বিপত্তি সৃষ্টি করে যা নরমাল ফোনগুলোতে হয়না। তবে স্মার্টফোন ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কিছু নির্দিষ্ট সুবিধা দেওয়া হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে স্মার্টফোনগুলি এবং নরমাল ফোনগুলি উভয়ই (প্যারাডক্সিকভাবে) ক্ষতির সৃষ্টি করতে পারে। প্রযুক্তি এখন প্রতিনিয়ত স্মার্ট এবং আপডেট হচ্ছে এবং সেই প্রযুক্তি গুলো স্মার্টফোনের সাথে কানেক্টেড হচ্ছে যা আমাদের দৈন্দিন জীনের সাথে জরিত। এছাড়াও স্মার্টফোনের মাধ্যমে কঠিন পরিস্থিতির সময়ে অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ করা, সাহায্য-সহোযোগীতা করা এবং গবেষণার কাজকে বিভিন্ন কমিউনিটির মাধ্যমে শেয়ার করার মধ্যমে সহজ করে তোলে।

“একটি স্মার্টফোন, একটি ভিডিও, শত সমস্যার সমাধান” এই স্লোগানটিকেও অশ্বীকার করা যাবেনা। স্মার্টফোনের মাধ্যমে ভিডিও ধারণ করে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে হাজারো সমস্যার সমাধান হয়েছে এমন খবর প্রচুর হয়েছে। মানুষের চরম দুর্ভোগের সময় সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে হাজারো মানুষ সহায়তা পেয়েছেন এমন খবর নেহাত কম নয়। তাই স্মার্টফোনের খারাপ দিকের পাশাপাশি অত্যধিক ভাল অধিক রয়েছে।

তবে আপনার লক্ষ্য যদি ইন্টারনেট যগত থেকে আলদা হয় তবে আপনার জন্য ফিচার ফোন বা নরমাল ফোনই যথেষ্ট। মানসিক ভাবে শান্তি পেতে সুন্দর আনন্দময়, প্রফুল্লময় জীবনকে উপভোগ করতে চাইলে ফিচার ফোন ব্যবহার করাটাই একমাত্র সমাধান হতে পারে। এছাড়াও এগুলোর বাইরে ফিচার ফোনের বাড়তি কিছু সুবিধা রয়েছে। নিচে ফিচার ফোনের কিছু ভাল দিক দেখে নিনঃ-

  • ফিচার ফোন স্মার্টফোনের থেকে অনেক বেশি শক্তপোক্ত হয়। অনেকে রাগ হলেই হাতে যা থাকে তাই আছাড় মেরে বসেন। তখন হাতে একটা স্মার্টফোন থাকলে তো কথাই নেই, ওটা শেষ। আবার অসাবধানতাবশত স্মার্টফোন হাত থেকে পড়ে গেলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। কিন্তু ফিচার ফোন সহজে নষ্ট হয় না।
  • আজকাল বাসের জানালা বা চলন্ত রিকশা থেকে মোবাইল ছোঁ মেরে নিয়া যাওয়া মানুষকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বাসে জানালার পাশে বসে কোন ধরনের চিন্তা ছাড়াই ফিচার ফোন কানে লাগিয়ে কথা বলতে পারবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফিচার ফোনের প্রতি চোরের দৃষ্টিই পড়ে না। চোরের নজর থাকে সবসময় দামী স্মার্টফোনের প্রতি। ছিনতাইকারীদের দুশ্চিন্তও বাদ দিতে পারেন। 
  • বর্তমানে প্রায় সব স্মার্টফোনই খোলার সুযোগ নেই। কিন্তু ফিচার ফোনের ব্যাকপার্ট, সাইডপার্ট সব খোলা যায়। আপনি সহজেই এইসব পার্ট খুলে পরিষ্কার বা যত্নআত্তি করতে পারবেন।
  • ফিচার ফোনে শক্তিশালী ব্যাটারি ব্যাকআপের সুবিধা পাওয়া যায়। ফিচার ফোন একবার চার্জ দিলে অনেকদিন চার্জ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যদিও স্মার্টফোনের ব্যাটারির শক্তি অনেক বেশি থাকে। কিন্তু এই ব্যাটারিও যেনো স্মার্টফোনের কাজের ধরন সামাল দিতে অক্ষম। 
  • ফিচার ফোনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- এটি ব্যবহারকারীকে আসক্ত করে ফেলে না। যখন তখন ফেসবুক ভাইবার হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা থেকে দূরে রাখবে। অনেক মানুষ আছেন যারা স্মার্টফোনই ব্যবহার করেন না, ফিচারফোনই একমাত্র তাদের ভরসা