ইব্রাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস – কুরবানীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইব্রাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস : কুরআন মাজীদের সূরা সফফাতের ১০২ থেকে ১০৮ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْىَ قَالَ يٰبُنَىَّ إِنِّىٓ أَرٰى فِى الْمَنَامِ أَنِّىٓ أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرٰى ۚ قَالَ يٰٓأَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِىٓ إِن شَآءَ اللَّهُ مِنَ الصّٰبِرِينَ

অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কী? সে বললঃ পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন।

ইব্রাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস

فَلَمَّآ أَسْلَمَا وَتَلَّهُۥ لِلْجَبِينِ

অতঃপর যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শোয়ালেন,

وَنٰدَيْنٰهُ أَن يٰٓإِبْرٰهِيمُ

তখন আমি তাকে ডেকে বলামঃ হে ইব্রাহীম!

قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْيَآ ۚ إِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِى الْمُحْسِنِينَ

তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে প্রমাণ করলে। আমি এরূপেই খাঁটি বান্দাদেরকে পুরস্কার দিয়ে থাকি।

إِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْبَلٰٓؤُا الْمُبِينُ

নিশ্চয়ই এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।

وَفَدَيْنٰهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ

আর আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান জবেহ  এর বিনিময়ে। -সূরা সফফাত, আয়াত ১০২-১০৭।

কোরবানির ইতিহাস

কোরবানি : কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই (হে নবী!) আমি আপনাকে (নিয়ামত পূর্ণ) কাওসার দান করেছি, অতএব, আপনি আপনার ‘রব’ এর সন্তুষ্টির জন্যে সালাত কায়েম করুন ও তাঁর নামে কোরবানি করুন’ (সূরা আল কাওসার-১০৮/১-২)। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করবে না সে যেন ঈদগাহের নিকটে না আসে’ (আহমদ ও ইবনে মাজাহ)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিনে মানবসন্তানের কোনো নেক আমলই আল্লাহ তায়ালার নিকট তত প্রিয় নয়, যত প্রিয় কোরবানি করা। কোরবানির পশুর শিং, পশম ও খুর কিয়ামতের দিন (মানুষের নেক আমলনামায়) এনে দেয়া হবে। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো’ (তিরমিজি)।

কোরবানির অর্থ

আমাদের সমাজে বাংলায় প্রচলিত কোরবানি শব্দের অর্থ হচ্ছে, নিকটবর্তী হওয়া বা সান্নিধ্য লাভ করা। আল কুরআনে সূরা আল মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘ইজ ক্কাররাবা-ক্কুরবা-নান’ অর্থাৎ যখন তার দু‘জনে কোরবানি পেশ করলো বা পশু জবাই করলো, বা জবাই করে ফেলে আসল। সূরা আল কাওসারে বলা হয়েছে, ‘ফাছল্লি লিরাববিকা ওয়ানহার’ অর্থাৎ অতএব, (হে নবী!) আপনার ‘রব’ এর স্মরণে সালাত আদায় করুন ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে কোরবানি করুন’। এখানে ‘নাহার’ বলতে কোরবানি বোঝানো হয়েছে। আসলে ‘নাহার’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, নহর, বিশেষ নিয়মে জবাই বা জবাই করা, জবাই করে হত্যা করা বা প্রিয় বস্তু জবাই করে হত্যা করা বা ত্যাগ করা।

ইবরাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস নিয়ে জাল বর্ণনা

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কে স্বপ্নে দেখানো হলো ‘তোমার প্রিয় বস্তুকে কুরবানী কর’। তখন তিনি ১০০ উট কুরবানি করলেন। আবার একই স্বপ্ন দেখানো হলে তিনি ১০০ দুম্বা কুরবানী করলেন। আবারও একই স্বপ্ন দেখানো হলে তিনি গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখলেন তার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে তার সন্তান ইসমাঈল আলাইহিস সালাম।

তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার স্ত্রী হাজেরাকে আলাইহিস সালাম বললেন ছেলেকে গোসল করে সাজিয়ে গুছিয়ে দেয়ার জন্য। বললেন, তিনি ছেলেকে নিয়ে দাওয়াত খেতে যাবেন। জবাইয়ের আগে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম তার পিতা হযরত ইবরাহীমকে বলেন, তিনি যেন তাকে শক্ত করে বেধে নেন। যেন বাবার গায়ে হাত পা ছুটাছুটির সময় পা লেগে না যায়।

আর তার রক্তে মাখা জামা-কাপড়গুলো যেন তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। যেন তার মা কাপড়গুলো নিয়ে সান্ত্বনা পান। ইসমাঈল আলাইহিস সালাম আরো বলেন তাকে কাত করে শোয়াতে। যেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার চেহারা দেখে মায়ার বশবর্তী হয়ে কুরবানী করা থেকে বিরত না হন। বলা হয় ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বারবার ছুরি চালাচ্ছিলেন কিন্তু কিছুতেই জবাই হচ্ছিল না। ইত্যাদি… ইত্যাদি… ইত্যাদি…

ইব্রাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস  – লক্ষ করার বিষয় হলো :

১. সূরা সফফাতের ১০২ নং আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ইবরাহীম আঃ স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, ইসমাঈল আঃ কে তিনি কুরবানি করছেন। কিন্তু প্রচলিত গল্পে বলা হয় তিনি বারবার “প্রিয় বস্তু” কুরবানি করার স্বপ্ন দেখেছেন। এরপর অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বুঝতে পারেন যে ইসমাঈল আঃ কে কুরবানি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু প্রিয় বস্তু কুরবানীর বিষয়টি কুরআনের এই আয়াতের বিরুদ্ধে যায়।

এই “প্রিয় বস্তু কুরবানীর” মিথ্যাকে কেন্দ্র করে কিছু অতি উৎসাহী মানুষ বলে থাকে হাট থেকে কেনা গরু ছাগলে কুরবানী হয় না। কারণ সেগুলো নিজের পালা পশু না। নিজে পাললে তার প্রতি মায়া জন্মে। এজন্য এগুলো দিয়ে কুরবানী হবে না। একটা বানোয়াট কথার উপর ভিত্তি করে আরেকটা বানোয়াট কথার উদ্ভব। আল্লাহ এসব মিথ্যা ও বানোয়াট কথা থেকে মুসলিমদের রক্ষা করুন।


 

২. গল্পে বলা হয়েছে ইবরাহীম আঃ তার স্ত্রীকে বলেছিলেন “ছেলেকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেয়ার জন্য। কারণ হিসাবে বলা হয় দাওয়াত খেতে যাবেন বা বেড়াতে যাবেন”। নাউযুবিল্লাহ! আল্লাহর একজন নবী ইবরাহীম আঃ মিথ্যা কথা বলে আল্লাহর একটি নির্দেশ পালন করবেন!!! নাউযুবিল্লাহ!

যেই ওয়াজেয়ীনগণ বা সমাজে যারা এ গল্প প্রচার করেন তারা সরাসরি একজন নবীকে মিথ্যাবাদী বানিয়ে দিচ্ছেন! আল্লাহ মাফ করুন। কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, “ইব্রাহিম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কী? সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। (সূরা সফফাত ১০২)” এখানে পিতা-পুত্র দুইজনই আল্লাহর নবী। পিতা সরাসরি পুত্রকে আল্লাহর আদেশের কথা বলেছেন। পুত্রও সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন করার জন্য। সেখানে আমরা মিথ্যাচার করে বানোয়াট গল্প প্রচার করে থাকি। নাঊযুবিল্লাহ্।

৩. হাত-পা বাধা বা কাত করে শোয়ানোর ব্যাপারে বলা হয় ইসমাঈল আঃ কাত করে শোয়াতে বলেছিলেন। যেন ইসমাঈলের আঃ চেহারা দেখে মায়া জন্মে ইবরাহীম আঃ কুরবানী থেকে ফিরে না আসে। এটাও ভিত্তিহীন কথা। কুরআনের বাণী থেকে জানতে পারি ইবরাহীম আঃ কাত করে ইসমাঈলকে আঃ শুইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামাঈল আঃ এমন কথা বলেছিলেন এটা কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।

গল্পের এই কথা দ্বারাও নবীর প্রতি বেয়াদবী হয়। কারণ এখানে সংশয় প্রকাশের অবকাশ তৈরি করা হয় যে, ইবরাহীম আঃ তার পুত্রের মায়ায় আল্লাহর হুকুম থেকে যেন ফিরে না আসেন। এটা খুবই অন্যায় কথা।

৪. গল্পে বলা হয় ইসমাঈল আঃ তার রক্তাক্ত জামা-কাপড় তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। যেন তার মা হাজেরা আঃ সেই কাপড়গুলো নিয়ে সান্ত্বনা পান। এ কথাও কুরআন বা হাদীস থেকে পাওয়া যায় না। গল্পকারদের মস্তিষ্ক প্রসূত এসব কথা তাই বিশ্বাস করা বা প্রচার করা যাবে না।

৫۔ হাবিলের দুম্বা কুরবানী হওয়া প্রসঙ্গে একটি হাদীস পাওয়া যায় কিন্তু তা সহীহ্ নয় বরং মুনকার তথা জাল। এজন্যই হাফেয ইবনে কাছীর রহ۔ বলেন,

والصحيح الذي عليه الأكثرون أنه فُدي بكبش

অর্থাৎ, সহীহ্ কথা হলো, কুরবানী একটি দুম্বা হয়েছে। (কিন্তু কোন্ দুম্বা তা নির্দিষ্ট নয়।) -তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা সাফফাত: ১০৭

কুরবানী সংক্রান্ত অনেক কথা বা ঘটনা ইহুদীদের বা ইসরাঈলী রেওয়ায়েত থেকে পাওয়া যেতে পারে। সেগুলোর মধ্যে যে কথাগুলো কুরআন-হাদীসের সাথে মিলে যায়, আমরা সেগুলো সেখান থেকে গ্রহণ করব। আর যে কথাগুলোর সত্যতার ব্যাপারে কুরআন-হাদীসের কোনো দলীল পাব না সেগুলোকে গ্রহণ করব না।

Read more – 
ভাল লাগলে ব্লগটি শেয়ার করুন-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *